সিলেটে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি হচ্ছে বেকারি পণ্য!

ডেইলি বিডি নিউজঃ সিলেট নগরের কালিঘাটে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা হচ্ছে নিমকি, সমুছা, বিস্কুট, চানাচুুর, বুট সহ আরও হরেক রকম মুখরোচক খাদ্যপণ্য। মঙ্গলবার সেখানে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের সিলেট জেলা সহকারী পরিচালক আমিরুল মাসুদ এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তিনি। যা মুহুর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
নিচে তার স্ট্যাটাস হুবুহু দেয়া হল
আমি লজ্জ্বিত!!!!! আমাকে ক্ষমা করবেন!!!
প্রতিদিনের মত আজকেও কর্মস্থল সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় আমার বাজার তদারকি অভিযান কর্যক্রম ছিল। তবে,আজকের কর্যক্রমের অভিজ্ঞতাটি ছিল একটু ভিন্ন। অভিযানের শুরুতেই সুরমা গেইট এলাকায় একটি মিষ্টান্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানায় তদারকি ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করার পর খোঁজ করছিলাম সিলেটের মসলা কারখানাগুলেতে কোন অনিয়ম চলছে কিনা। দুপুরের পরে সিলেট শহরের চালিরবন্দরের রাস্তা ধরে এগোচ্ছিলাম কালিঘাটের মসলা মিলগুলোর দিকে। কিছুদূর যেতেই অন্যরকম এক ভাঁজাপোড়া আর তেলের উদ্ভট গন্ধ নাকের মধ্যে এসে লাগলো। সঙ্গে প্রটেকশনের দায়িত্বে থাকা RAB-9 এর হাবিলদার রফিক সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম এ গন্ধটি কোথায় থেকে আসছে!!!! হাবিলদার সাহেবও আমার মত কোন কিছু বুঝে ওঠতে পারছিলেন না। তিনি অগত্যা পাশের এক দোকানিকে জিঙ্গেস করলে, দোকানি এক উদাসীন ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে আবার কি একটা কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। ভাবখানা এমন যেন, এ আর এমনকি!! যে একেবারে গাড়ির বহর থামিয়ে জিঙ্গেস করছো!!! দোকানির এহেন ইশারাটি দেখে আমার সন্দেহ আরো বেড়ে গেলো। হাবিলদার সাহেবকে বললাম,গাড়ি দুইটিকে সাইড করতে বলেন, আমরা এখানে নামবো।” হাবিলদার সাহেব আমার কথাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। প্রস্তুতি নিলেন পূর্ণ অভিযানের। আমি ও আমার সহকারীসহ RAB-9 এর আরো প্রায় ৮-১০ জন্য সদস্য হাটা শুরু করলাম দোকানির দেখানো গলির ভেতরের বস্তির পথে। হাটছি আর অবাক হচ্ছি.—-আমাদের দেখে বস্তির ভেতর সবার মধ্যে কি যেন এক উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। শিশু, যুবক-যুবতি,পুরুষ-মহিলা, বৃদ্ধরা সবাই কেমন যেন ছুটাছুটি শুরু করেছে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। নিজেই যেন বিব্রত বোধ করছি। ক্রমশই বাড়ছে কৌতূহল!!! এমন সময় হঠাৎ কানে আসলে একটি জরাজীর্ণ টিনের ঘরের ভিতর থেকে আসা খটখট মেশিনের আওয়াজ। তড়িৎ গতিতে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন টিমের সামনে থাকা হাবিলদার সাহেব। পেঁছনে পেঁছনে আমরাও। ভেতরে ঢুকে তো চোখ ছাঁনাবড়া। এতো এক বিশাল কর্মযঙ্গ। শিশু-বৃদ্ধ-আবাল-বনিতা যে যে-ভাবে পাড়ছে, তৈরী করছে ছোট ছোট নিমকি, সমুছা, বিস্কুট সহ আরো অনেক বেকারি পণ্য। পাশে আবার ভাঁজা হচ্ছে ছানাচুুর, বুট সহ আরো হরেক রকম মুখরোচক খাদ্যপণ্য। এ অবস্থা দেখে, উপায়ান্ত না পেয়ে তলব করলাম এ ঘরের মালিককে। একজন বললেন, তিনি পেছনের ঘরে কাজ করছেন। আমরা অন্ধকারের মধ্যে আস্তে আস্তে পেছনের ঘরে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমদের ভাষা হারানোর উপক্রম। ঘরের মালিক নিজে ময়দার খামিরকে নোংরা মেঝেতে রেখে তার উপর উঠে তার দুই পায়ের সাহায্যে সেগুলোকে পক্রিয়াজাত করছেন। আমাদের দেখে তড়িঘড়ি করে একটি খালি বস্তা টেনে খামীরের উপর রাখলেন। ততক্ষনে পরিস্থতি আমাদের কাছে অনেকটাই পরিস্কার। আমরা তাকে আটক করলাম। শুরু করলাম জিঙ্গাসাবাদ। চতুর্মূখী প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে একের পর এক গা শিউরে ওঠার মত তথ্য দিচ্ছেন তিনি। প্রথমে জানালেন,এ বস্তিতে ২০০টি ঘর আছে, যাদের প্রত্যেকটিতে একই কায়দায় তৈরি হচ্ছে বেকারি পণ্য। এসব পণ্য তারা নিজেস্ব লোকদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন পুরো সিলেট জেলায়। বিক্রি হচ্ছে শহরের নামিদামি এলাকায়,এমনকি অভিজাত শপিংমল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে।
প্রতিদিন প্রায় ৫-১০ লক্ষ টাকার খাদ্য পণ্য বিক্রি হয় এ বস্তি থেকে। তিনি আরো জানালেন, ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বস্তিবাসীরা এই কাজ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। তার দেয়া এসব মূল্যবান তথ্যের ভিত্তিতে আমি ও আমার টিম নেমে পড়ি বস্তির বিভিন্ন ঘর তল্লাসীতে। তল্লাসী চালিয়ে দেখা যায়, ২০০ নয় বরং বস্তির প্রায় প্রতিটি ঘরেই অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর আর নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে শত শত বস্তা বাহারি খাবার। কেউ মেঝেতে,কেউ শোয়ার বিছানায়, কেউ বারান্দায়, কেউ বা আবার রান্নাঘর কিংবা গোসলখানার সামনে তৈরি করছেন এসব খাবার। একে তো বস্তি তার উপর আবার নোংরা পরিবেশে এত বিপুল পরিমান খাদ্য দ্রব্য তৈরি দেখে রাগে ভেতরটা যেমন ফেটে যাচ্ছিল, ঠিক তেমনি বার বার মনে হচ্ছিল, এ পরিবার গুলোর অবিরাম সংগ্রাম আর অসহায়ত্বের কথা। কতটা বাধ্য হলে মানুষ তার কোলের শিশুকে দিয়ে কাজ করায়, কতটা অপরাগ হলে মানুষ তার শোবার বিছানাটিকেও ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহের কাজে। একবার মনে হচ্ছিল সব গুড়িয়ে দেই, নদীতে ফেলে দেই এসব অখাদ্য কুখাদ্য। আবার পরক্ষনেই মনে হল, তাহলে এই যে দুই হাত দিয়ে নিমকি তৈরি করতে থাকা গৃহবধুটির কোলের কোনে ঝুলে আছে হাড্ডিসার নিষ্পাপ শিশুটি, সে হয়তো না খেয়েই ঘুমুতে যাবে আজকের রাতে। চিন্তা আসলো, আদতে তাদের কি কোন দোষ আছে!! কী-ই -বা করার আছে এই অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলোর। আমাদের রাষ্ট্র তো পারেনি তাদের মুখে দুবেলা দুমুটো ভাত তুলে দিতে। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই তো বেঁচে আছে তারা। হঠাৎ করে কোন অধিকারে আমি তাদের এ সাজানো সংসার ভেঙ্গে তছনছ করবো। আমি কি পারবো তাদের বিকল্প আয়ের রাস্তা তৈরি করে দিতে। এ সুযোগ কি আছে আমার!!এসব চিন্তা করতে করতে কখন যেন সন্ধ্যা হয়ে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে ঠাহরই করতে পারলাম না। অবশেষে,সবকিছু ভেবে-চিন্তে তাদেরকে অন্তত অল্পবিস্তার সচেতন করার উদ্দেশ্যে পুরো বস্তিতে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করলাম। তবে বিশ্বাস করেন, অনেক ইচ্ছা থাকা সত্বেও ধ্বংস করতে পারি নি একটি অখাদ্য পণ্যও। কেন যেন নিজের বিবেকের সাথেই যুদ্ধ করে হেরে যাচ্ছিলাম বারবার৷ আজকে আমি বন্ধ করতে পারিনি আমার চোখের সামনে উৎপাদিত হওয়া অস্বাস্থ্যকর খাদ্য পণ্য। আমি পারি নি আপনাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে। এ যে আমার এক অন্যন্য ব্যর্থতা। আমি লজ্জ্বিত। আমাকে ক্ষমা করবেন। কিছুই করার ছিল না আমার!!!!!!